পিঠা ও বাঙালী এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রত্যেক দেশেরই একটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন থাকে যা তাদের খাদ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা নিংসন্দেহে পিঠা । আমাদের জন্য পিঠা শুধু একটি খাবারই নয় এটি আমাদের পরিচয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে পিঠা খাওয়ার প্রচলন অনেক প্রাচীন। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাওনী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতপৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কাজল রেখা গল্পের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
যেহেতু প্রাচীন বইপুস্তুকে পিঠার উল্লেখ আছে , কাজেই ধরে নেওয়া যায় পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাঙলি সমাজে অনেক প্রাচীন।
অগ্রাহণ মাসে নতুন ধান ওঠার পর সেগুলো গোলাবন্ধি করতে কিছুটা সময় লেগে যায় , ঐ সময় কর্মব্যস্ত গ্রামীণ মানুষের শখ করার সময় টুকুও থাকে না। নবান্নের পরে জাঁফিয়ে শীত পড়লে পৌষ সংস্কৃতি পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। তারপর বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে হরেকরকমের পিঠা খাওয়ার ধুম। চলে বিভিন্ন রকম পিঠা উৎসব।
বাঙালির ভোজন বিলাসের শুধু পিঠা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আত্মীয়স্বজন ও পারস্পারিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় ও মজবুত করতে, অতিথী আপ্যায়নে, জামায় আদরে, পিঠার ভুমিকা অপরিসীম পিঠার রসে বাঙালী যেমন নিজে মজে মজায় সকলকে।
গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস এবং তৈরির ধুম শীতকালেই বেশি পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধুরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটায় পিঠা তৈরিতে । এ সময়ে খেজুরের রস থেকে গুড় পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গগ্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে।
বাঙালির পিঠা উৎসব একটি অসাম্প্র্রদায়িক উৎসব। ধর্ম বর্ণ নির্মিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে মেতে ওঠে। হিন্দু সমাজে যেমন নতুন ধানের নতুন চালে জমে ওঠে পৌষ-পার্বন মুসলমান সমাজেও তেমনই ফুটে ওঠে পিঠা-পায়েসের আনন্দ। এই উৎসব সবাইকে বাঁধ প্রানের বাঁধনে।
বিচিত্র ধরনের ও নামের পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা। এছাড়াও আছে চিত ই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধুকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলপুলি, পাটিসাপ্টা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, বিবিখানা, ঝাল পিঠা, তেল পিঠা ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রায় শতাধিক পিঠা প্রচলন আছে। এর মধ্যে অঞ্চল ভিত্তিক অনেক আঞ্চলিক পিঠাও আছে। কালের গভীরে কিছু হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
শীতকালে শুধু গ্রাম বাংলায়ই নয় শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি থাকুক না কেন, পিঠা প্রতি তাদের অনুগ্রহ কমেনা শহরের নারী কর্মব্যস্ত, সবসময় তাই গ্রামীণ নারীদের মতো পিঠা বানানোর ততোটা সময় তাদের হাতে থাকেনা । তাই বলে যে তারা একেবারই পিঠা বানায় না তা নয়। তবে শীতকালে শহরের সবখানেই ঠেলাগাড়ি ভ্যানে চিতই পিঠা বিক্রি করা হয়। সঙ্গে থাকে হরেক রকমের ভর্তার সমারহ। আর যারা মিষ্টি প্রেমী তাদের জন্য তো ধায়া ওঠা গরম গরম গুড় মালাই ও নারকেলে ভরা ভাপা পিঠা থাকেই । বর্তমানে শহরে নানা ধরণের পিঠার দোকান বসে। সেখানে বিক্রি হয় হরেক রকমের পিঠা। রাস্তার পাশে বা সুপার সপে দাড়িয়ে আমরা পিঠা খাই বা বাসায় ফেরার পথে পরিবারের জন্য যখন পিঠা কিনি তখন আমাদের মধ্যে এক রকম অনন্দ কাজ করে। পিঠা পুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ। আমাদের হাজারো সমস্যা সত্তে¡ ও গ্রাম বাংলার এসব পিঠা পার্বণের আনন্দ উদ্দীপনা এখনো ¤øান হয়নি বরং ছড়িয়ে পরেছে শহরের আনানে কানাচে। পিঠা পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে।